এন্টিবায়োটিক আশীর্বাদ অথবা অভিশাপ ভুল করছেন না তো!

সম্প্রতি একদল গবেষক হাঁপানি রোগের সঙ্গে এন্টিবায়োটিকের এক অদ্ভুত সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। তাহলে যে এন্টিবায়োটিক জীবন রক্ষা করে সে-ই কি অভিশাপ হয়ে দেখা দিচ্ছে?

এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বেশ কিছুদিন ধরেই বিশ্বের বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে। বিশেষ করে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় এলার্জিজনিত হাঁপানির প্রকোপ বেড়ে যাওয়া নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন শঙ্কিত। বিশ্বব্যাপী এ্যাজমা বা হাঁপানির প্রকোপ বাড়ছে। বিশেষ করে বাড়ছে উন্নত বিশ্বে। এখানেই প্রশ্ন উঠেছে এই বাড়ার উৎস নিয়ে। এতকাল ধারণা ছিল বায়ুদূষণই এ্যাজমা বা হাঁপানির মূল উৎস। দূষণই যদি এর উৎস হয়, তাহলে তো উন্নয়নশীল বিশ্বই এর প্রধান আক্রমণের স্থান হবার কথা। কিন্তু উন্নত বিশ্ব কেন?

গত কয়েক দশকের পরিসংখ্যান তাই চিন্তায় ফেলে দেয় উন্নত বিশ্বের বিজ্ঞানীদের। দেখা যায়, গত কয়েক দশকে উন্নত বিশ্বে দ্রুত হারে এ্যাজমা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এটা এখন এই অঞ্চলে বড় সমস্যা হিসাবেই চিহ্নিত। দেখা গেছে, ১৯৭০-এর দশক থেকে উন্নত বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৫০ শতাংশ হারে বাড়ছে এ্যাজমা বা হাঁপানি রোগীর সংখ্যা। সত্তরের দশকের তুলনায় এখন বিশ্বজুড়ে হাঁপানি রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। এক হিসাবে দেখা যায়, বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় পনেরো কোটি মানুষ এই রোগে ভুগছে। পুরো বিষয়টি শঙ্কিত করে তুলেছে চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষক থেকে নীতিনির্ধারক পর্যন্ত সবাইকে। প্রশ্ন উঠেছে কেন এমনটি ঘটছে? কারণ হাঁপানি এমন একটি রোগ যা মানুষের কর্মক্ষমতা বা উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়। কিন্তু সে দীর্ঘজীবী হয়। অথচ ধুঁকতে থাকে সারা জীবন।

এন্টিবায়োটিক আশীর্বাদ অথবা অভিশাপ কিভাবে

এমন এক পরিস্থিতির জন্যই টনক নড়ে গবেষকদের। শুরু হয় গবেষণা। সম্প্রতি একদল গবেষক হাঁপানি রোগের সঙ্গে এন্টিবায়োটিকের এক অদ্ভুত সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। তাহলে যে এন্টিবায়োটিক জীবন রক্ষা করে সে-ই কি অভিশাপ হয়ে দেখা দিচ্ছে? গবেষকরা দেখেছেন যে শিশু বয়সে যাদের অতিমাত্রায় এন্টিবায়োটিক খাওয়ানো হয়, তাদের হাঁপানিতে আক্রান্ত হবার প্রবণতা বেশি থাকে। এ থেকে তাঁদের ধারণা হয়েছে এ্যাজমা বা হাঁপানিতে আক্রান্তদের এই প্রবৃদ্ধিতে এন্টিবায়োটিকের ভূমিকা রয়েছে। এন্টিবায়োটিকের সঙ্গে এ্যাজমার যোগসূত্র এই প্রথমবারের মতো খুঁজে পাওয়া গেছে তা নয়, এর আগেও তা পাওয়া গিয়েছিল। তবে এবারের এই পরীক্ষা আগেরবারের চেয়ে আরও বেশি স্বচ্ছ ধারণা দিয়েছে এবং এখানেই এবারের পরীক্ষা বা গবেষণার বিশেষত্ব।

আগের গবেষণার চেয়ে এবারের গবেষণার পার্থক্য কোথায়?

এবারের গবেষণায় শিশুদের জন্ম থেকে সাত বছর বয়স পর্যন্ত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এবারের পর্যবেক্ষণে শুধু শিশুদের মা-বাবার স্মৃতির ওপর ভরসা করা হয়নি বরং সরেজমিনে সমীক্ষা চালানো হয় প্রত্যক্ষভাবে। এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ডেট্রয়েটের হেনরি ফোর্ড হাসপাতালের এপিডেমিওলজিস্ট ডা. ক্রিস্টিন কোল জনসন। তিনি মোট ৪৪৮ জন শিশুর মা- বাবাকে টেলিফোনে সাক্ষাত করার জন্য অনুরোধ করেন। তাদের কাছ থেকে তিনি তাদের এক বছর থেকে তিন বছর বয়সী শিশুদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে খোঁজখবর নেন। জানতে চান এর মধ্যে তাদের কি কি অসুখ হয়েছিল এবং কি কি ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল ইত্যাদি। এর পর এসব নমুনা শিশুর বাড়িতে যাওয়া হয় তাদের দুই বছর ও চার বছর বয়সের সময়। নমুনা নেয়া হয় এসব শিশুর বাড়ির বা গৃহের বাতাস ও ধুলার। এছাড়াও গবেষকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে উপাত্ত সংগ্রহ করেন যে ঐ বাড়িতে কোন পোষা প্রাণী আছে কি না। থাকলে ঐ প্রাণীটির গৃহে অবস্থান কোন্ পর্যায়ে এবং ঐ প্রাণীটি কি-বিড়াল, কুকুর অথবা অন্য কোন প্রাণী? প্রাণীর সংখ্যা এবং প্রাণীগুলো একাধিক প্রজাতির কিনা সে তথ্যও তাঁরা সংগ্রহ করেন। একই সঙ্গে তথ্য সংগ্রহ করা শিশুরা ছোটবেলায় মায়ের দুধ খেয়েছে কি না। খেয়ে থাকলে কতদিন পর্যন্ত ইত্যাদি। এগুলো সংগ্রহের মাধ্যমে তাঁরা শিশুদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও তার নিরাপত্তা পরিমাপ করেছেন।

এছাড়াও গবেষকরা সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন শিশুগুলোর ছোটবেলার অসুখ ও তার জন্য প্রদত্ত ওষুধের ওপর। তাঁরা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ও নোটসের পর্যালোচনা করেছেন। দেখেছেন এন্টিবায়োটিক পরামর্শ দেয়া হয়েছে কিনা। এন্টিবায়োটিক দেয়া হলে তা কী ধরনের এন্টিবায়োটিক। এটা তাঁরা করেছেন এন্টিবায়োটিকের পার্থক্য করার জন্য। “ব্রড- স্পেক্ট্রাম” ধরনের এন্টিবায়োটিক অর্থাৎ পেনিসিলিন যৌগ অথবা “ন্যারো স্পেক্ট্রাম” অর্থাৎ শুধুমাত্র পেনিসিলিন বা অন্য কোন ম্যাক্রোলিডস এন্টিবায়োটিকের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্য রয়েছে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার বেলাতেও। এসব কিছু খতিয়ে দেখতেই তাঁরা তাঁদের গবেষণাপত্রের প্রশ্নমালা নির্ধারণ করেন। এখানেই শেষ নয়, এর পর পর্যায়ক্রমে শিশুদের স্বাস্থ্য অনুসরণের পর যখন তারা সাত বছরে পা রাখে, তখন তাদের পুরো স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। দেখা হয় তাদের এ্যাজমা বা হাঁপানির সামান্যতম আশঙ্কাও আছে কি না।

ডা. জনসন ও তার সতীর্থদের প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল এটপিক এ্যাজমার বিষয়টি। কারণ এই এ্যাজমা বা হাঁপানি হচ্ছে এমন এক ধরনের হাঁপানি যা এলার্জির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এমনিতেই ধারণা করা হয়, হাঁপানি হচ্ছে এক ধরনের এলার্জিজনিত অসুখ। গবেষণার এই বিশাল আয়োজনে ডা জনসন কী ফল পেয়েছেন আসলে বিবেচ্য বিষয় সেটি।

ডা. জনসন ও তাঁর সঙ্গীরা দেখতে পান যে তাঁদের নমুনা শিশুদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক সংখ্যককে জন্মের ছয় মাসের মধ্যে এন্টিবায়োটিকের চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এদের

জীবনের জন্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া ডেকে আনে। এই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় ইমিউন ব্যবস্থায় এবং ওষুধের পার্শ্ব বা উল্টো প্রতিক্রিয়ায় দেখা দেয় হাঁপানি বা অন্য এলার্জিপ্রবণতা। তবে এখনও সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। সীমাবদ্ধতাটি হচ্ছে ঠিক কিভাবে শিশুর ইমিউন ব্যবস্থা শরীরের ভাল ব্যাকটেরিয়া ও খারাপ ব্যাকটেরিয়াকে আলাদা করে তা এখনও শনাক্ত করা যায়নি

সঙ্গে বাকি অর্ধেকের বেলায় তা হয়নি। তিনি দেখতে পান যে সব শিশুকে জন্মের দিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে এন্টিবায়োটিক দেয়া হয়েছে, তারা, যাদের এন্টিবায়োটিক দেয়া হয়নি তাদের চেয়ে আড়াই গুণেরও বেশি এ্যাজমা বা হাঁপানিপ্রবণ। আরও দেখতে পান, যে সব শিশুকে তুলনামূলকভাবে বেশি এন্টিবায়োটিকের চিকিৎসা দেয়া হয়েছে তারা হাঁপানির বিষয়ে বেশি ঝুঁকিপ্রবণ। গবেষণায় আরও দেখা যায়, ‘ব্রড স্পেক্ট্রাম’ এন্টিবায়োটিকে এই ঝুঁকি আরও বেশি করে বাড়ে। এন্টিবায়োটিক প্রয়োগের এই ফলাফল শুধু যে হাঁপানির জন্য প্রযোজ্য তা নয়, সব ধরনের এলার্জিপ্রবণতাই এতে বেড়ে যায়। এন্টিবায়োটিকের সঙ্গে শিশুদের এই সম্পর্ক চিকিৎসা শাস্ত্রে নতুন চিন্তার খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডা. জনসন তাঁর গবেষণার এই ফলাফল নিয়ে বসে থাকেননি। 

তিনি সঙ্গত কারণেই বিজ্ঞানীদের জন্য তা তুলে ধরেন গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে। এ সময়েই অনুষ্ঠিত হয় ভিয়েনায় ইউরোপিয়ান রেসপিরেটরি কংগ্রেস। তিনি কংগ্রেসে তাঁর এই গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন। কংগ্রেসের আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয় যে জীবনের শুরুতেই এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার শিশুদের ভবিষ্যত জীবনের জন্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া ডেকে আনে।

এই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় ইমিউন ব্যবস্থায় এবং ওষুধের পার্শ্ব বা উল্টো প্রতিক্রিয়ায় দেখা দেয় হাঁপানি বা অন্য এলার্জিপ্রবণতা। তবে এখনও সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। সীমাবদ্ধতাটি হচ্ছে ঠিক কিভাবে শিশুর ইমিউন ব্যবস্থা শরীরের

ভাল ব্যাকটেরিয়া ও খারাপ ব্যাকটেরিয়াকে আলাদা করে তা এখনও শনাক্ত করা যায়নি। তবে সাধারণভাবে ধারণা করা হয় খারাপ ব্যাকটেরিয়া যখন ভাল ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে শক্তিশালী হয়, তখনই শরীর অসুখে আক্রান্ত হয় এবং শারীরিক যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তার ব্যতিক্রম ঘটায়। এই খারাপ ব্যাকটেরিয়াকে প্রতিহত বা মারার জন্য এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এন্টিবায়োটিকের খারাপ ও ভাল ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা নেই। সমস্যাটি এখানেই। শরীরে প্রয়োগ করা এন্টিবায়োটিক একসঙ্গে মন্দ ও ভাল দুই ধরনের ব্যাকটেরিয়াকেই আক্রমণ করে এবং মেরে ফেলে। ফলে শরীরের যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তা ব্যাহত হয় বা এলোমেলো হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াতেই হয়ত হাঁপানি বা অন্য সব এলার্জি প্রবণতা শরীরে জেঁকে বসে। যদি তাই হয় তাহলে?

ভিয়েনার ঐ কংগ্রেসে সে বিষয়েও আলোচনা হয়। বলা হয়, শিশু বয়সের বিভিন্ন সংক্রমণ পরবর্তী জীবনের বিভিন্ন ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদী অস্বস্তিকর অসুখবিসুখের আশঙ্কা কমিয়ে দেয়। এর কারণ হিসাবে বলা হয় হাইজিন হাইপথেসিস নামের ইমিউন ব্যবস্থাকে। যেভাবেই হোক শিশু বয়সের বিভিন্ন সংক্রামক রোগ এই ইমিউন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে এবং শরীরের ভিতরে এক ধরনের প্রতিরোধমূলক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এর মানে কী দাঁড়ায়? ধনী দেশগুলোর উন্নত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে শিশু বয়সে সংক্রমণে আক্রান্ত হবার হার কমে গেছে। আর সংক্রমণে আক্রান্ত হলে এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয়। এতে শিশু দ্রুত আরোগ্য লাভ করে। কিন্তু এর এক ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে শিশুদের ইমিউন ব্যবস্থায়। এ জন্যই সম্ভবত ধনী বিশ্বে ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদী অস্বস্তিকর অসুখের প্রবণতা বাড়ছে। এই হাইপথেসিসের পক্ষে যতই প্রমাণ মিলছে ততই মানুষের বিশ্বাস দৃঢ়মূল হচ্ছে এর পক্ষে। এটা যে শুধু বিজ্ঞানীদের জন্য প্রযোজ্য তা নয়, সাধারণ্যেও এ ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে। মায়েরা রান্নাঘরের অপরিচ্ছন্নতা বা খাটে বিড়ালের লোম নিয়ে যে সংশয়ে ছিলেন তা কমে যাচ্ছে।

তাঁরা ভাবছেন শিশুদের কাদামাটিতে ও পোষা জীবজন্তু ও পাখিদের সঙ্গে খেলতে দিলে হয়ত অসুস্থ হতে পারে। তবে তা ক্ষণস্থায়ী। পরবর্তী জীবনে এসব সংক্রমণই তাকে ক্রনিক কোন অসুখের হাত থেকে রক্ষা পাবার শক্তি যোগাবে। বিশেষ করে এ্যাজমা বা হাঁপানি জাতীয় এলার্জিজনিত অসুখ থেকে। ধনী বিশ্বের কাছে এই বোধোদয় যতটা স্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে, আমরা তৃতীয় বিশ্বের মানুষ ততই বিপরীত দিকে ধাবিত হচ্ছি। এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার, বিশেষ করে শিশুদের চিকিৎসায় ব্রড স্পেক্ট্রাম এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার আমাদের স্বাস্থ্যচিত্রে কেমন প্রতিক্রিয়া ফেলছে তার পরীক্ষা বা গবেষণাও জরুরী। আমাদের নিজস্ব জীবনযাপন! ব্যবস্থায় যে ইমিউন প্রক্রিয়া গড়ে ওঠে তা কি ব্যাহত হচ্ছে?

এ প্রশ্ন উঠতেই পারে।

দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে

Leave a Comment