৭ উপায়ে আপনার লিভার সতেজ রাখুন সহজেই!

আপনার শরীর আপনার করণীয়

ছোট বেলায় পেটের গোলমাল ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। বিশেষ করে মামা-খালার বাড়িতে গেলে কাঁড়ি কাঁড়ি খাবার । নির্ঘাত বদহজম। সঙ্গে সঙ্গে মামার অভিমত- ছেলেটার লিভারের অবস্থা খুব খারাপ। একটুও হজম করতে পারে না। তখন শুরু হলো সকাল বেলায় খালি পেটে বাতাসার গায়ে কাঁচা পেঁপের কষ মিশিয়ে খাওয়ানো আর লিভার টনিক । সেটিও যথেষ্ট উপাদেয় । তবে প্রসঙ্গ হচ্ছে লিভার। সেই বয়স থেকেই লিভার শব্দটি মনে গেঁথে গেছে। সেই সঙ্গে এটাও মনের মধ্যে ঢুকে গেছে যে লিভার হচ্ছে শরীরের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ, যা বিগড়ে গেলে খাওয়ার মতো দারুণ আনন্দময় ব্যাপারও পানসে হয়ে যায়। পরে চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়তে গিয়ে জেনেছি, লিভার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ । মানুষের বেঁচে থাকার সঙ্গে লিভারের সম্পর্ক অপরিহার্য । আমাদের বুক ও পেট যেখানে ভাগ হয়েছে, ঠিক সেখান থেকেই লিভারের শুরু। বুকের ও পেটের অঙ্গকে আলাদা করে রেখেছে ডায়াফ্রাম নামক একটি শক্ত আঁশ-মাংসের তৈরি দেয়াল । তার ঠিক নিচে গায়ে গায়ে লাগানো আমাদের লিভার।

লিভার একটি বড় অঙ্গ । পেটের মধ্যে যত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে, যেগুলোর ইংরেজি নাম ভিসেরা, সেগুলোর মধ্যে আকারে সবচেয়ে বড় হচ্ছে লিভার । আবার লিভার একটি গ্ল্যান্ডও বটে, পুরো শরীরের মধ্যে সবচেয়ে বড় গ্র্যান্ড হচ্ছে লিভার। জীবিত শরীরের লিভার দেখতে বাদামি লাল । এটি খুব ভঙ্গুর একটি অঙ্গ । হাত দিয়ে স্পর্শ করলে অনুভব করা যাবে যে লিভার খুবই নরম। মাতৃগর্ভে ভ্রূণের বয়স চার সপ্তাহ হতেই লিভার তৈরি শুরু হয়ে যায়। পূর্ণবয়স্ক একজন পুরুষের লিভারের ওজন হয় ১৬০০ গ্রাম, মেয়েদের বেলায় ১৩০০ গ্রাম ।

লিভার সতেজ রাখুন সহজেই
লিভার সতেজ রাখুন সহজেই, কথায় আসে পেট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি

লিভার অনেক কাজের কাজী:

লিভারের কাজের ফিরিস্তি শুনলেই এর গুরুত্ব কিছুটা বুঝতে পারা যায়। লিভারের আরেক নাম হচ্ছে শরীরের ‘পাওয়ার হাউজ’ । আমাদের প্রতি কাজে, তা যত ছোটই হোক আর বড়ই হোক, শক্তি প্রয়োজন। আর পুরো শরীরে সেই শক্তির যোগান দেয় লিভার । তার মানে লিভার থেমে গেল তো শরীরের সব কাজ থেমে গেল । আমরা শর্করা, চর্বি, প্রোটিন- যা কিছু শরীরে গ্রহণ করি, সেগুলোকে শক্তিতে রূপান্তর করা ও কাজে লাগানোর দায়িত্ব পালন করে লিভার। লিভার তৈরি করে শরীরের জন্য অপহিার্য অনেক জিনিস। আমাদের শরীরে যে পিত্ত থাকে, যা না থাকলে চর্বিজাতীয় খাবার হজম করা অসম্ভব, সেই পিত্ত তৈরি হয় লিভারে।

রক্ত তৈরি হয় লিভারে। লিভার ছাড়াও শরীরের আরও কয়েকটি জায়গায় রক্ত তৈরি হতে পারে। কিন্তু রক্তের যে প্লাজমা প্রোটিন, যেসব রক্তের মধ্যকার সব কণিকা তৈরিতে অপরিহার্য, সেগুলো তৈরি হয় লিভারেই। আমাদের শরীরে কোনও অ্যান্টিজেন (যেসব জিনিস রোগ তৈরি করে) ঢুকলে তার প্রতিক্রিয়ায় শরীর তৈরি করে অ্যান্টিবডি। অ্যান্টিবডি আমাদের শরীরের রোগ- প্রতিরোধতন্ত্রের একটি বড় উপাদান। এই অ্যান্টিবডির একটি বড় অংশ তৈরি করে লিভার।

আমাদের শরীরের মধ্যে রক্ত তো চব্বিশ ঘণ্টাই প্রবহমান। রক্তের প্রবহমানতা হাজার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যেমন বাইরের শীত-গ্রীষ্মের তারতম্য, শরীরে কোনও জমাটকারী জিনিসের অনুপ্রবেশ। তারপরও রক্ত জমাট না বেঁধে প্রবহমান থাকতে পারে, তার কারণ হচ্ছে রক্তে সব সময় হেপারিন নামক একটি পাকস্থলী | প্রাকৃতিক রক্ত-তরলীকরণ পদার্থের সরবরাহ । এই হেপারিন তৈরি ও সরবরাহ করে লিভার।

আমাদের কোনও অংশে কেটে গেলে রক্ত পড়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা। আবার ক্ষত যদি খুব বড় না হয়, তাহলে রক্তপাত এমনিই বন্ধ হয়ে যায় । তার মানে রক্তপাত বন্ধ হওয়ার একটি প্রক্রিয়া শরীরের মধ্যে ক্রিয়াশীল রয়েছে । এই প্রক্রিয়াটিকে এক কথায় বলা যেতে পারে ক্লটিং প্রসেস। এই প্রক্রিয়া সফলভাবে চালাতে হলে প্রয়োজন পড়ে ১৩টি উপাদানের । সেগুলোর মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে প্রোথ্রোম্‌বিন ফিব্রিনোজেন। এই উপাদান দুটির একমাত্র প্রস্তুতকারক হচ্ছে লিভার।

আমাদের শরীরের তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর ব্যাপারটি তো রয়েছেই, এর পাশাপাশি রয়েছে ‘ ভবিষ্যৎ প্রয়োজন মেটানোর জন্য আপৎকালীন খাদ্যভাণ্ডারের প্রয়োজনীয়তা। মানুষ যেমন ভবিষ্যতের প্রয়োজনে খাদ্য সংগ্রহ করে রাখে, সরকার যেমন গুদামে গুদামে চাল-গম মজুদ করে রাখে, তেমনই শরীরের বাড়তি গ্লুকোজ, খনিজ পদার্থ ও ভিটামিনগুলোকে শরীর মজুদ করে রাখে লিভারে। আমরা তো আর চব্বিশ ঘণ্টাই শরীরে জ্বালানি দেওয়ার জন্য অবিরাম খাদ্য গ্রহণ করে যেতে পারি না। আমাদের আরও অনেক কাজ করতে হয়। দিনে ছয় থেকে আট ঘণ্টা ঘুমাতেও হয়। সেই সময়টুকুতে শরীরে জ্বালানি পৌছায় আমাদের রিজার্ভে রাখা খাদ্যভাণ্ডার থেকে। লিভার আমাদের শরীরের অন্যতম খাদ্যভাণ্ডার । আর একটি কাজ রয়েছে, শরীর থেকে বর্জ্য ও বিষাক্ত জিনিসগুলো বের করে দেওয়া । লিভার এই কাজ প্রতিনিয়ত পালন করে যাচ্ছে খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে।

এমন একটা কার্যকর যন্ত্রকে আমৃত্যু কর্মক্ষম রাখা জরুরি। তাই আমাদের লিভারকে সতেজ রাখতে হলে কিছু কাজ যেমন করতে হবে, তেমনি কিছু কাজ থেকে বিরতও থাকতে হবে। তার আগে জানা দরকার লিভার সুস্থ আছে কি না।

লিভার অসুস্থের লক্ষণ

  • একটি উপসর্গের কথা আমরা সবাই জানি । চলতি কথায় যাকে বলা হয় জন্ডিস । জন্ডিস হলে চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া, প্রস্রাব হলুদ হওয়া, খাবারে চরম অরুচি, প্রচণ্ড শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয়।
  • শরীরের বিভিন্ন অংশে পানি জমে যায় যেসব কারণে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লিভারের অসুখ।
  • রক্তপাত বন্ধ হতে না চাওয়া, ঘন ঘন বমি হওয়াকে অনেক সময় লিভারের অসুস্থতার লক্ষণ হিসাবে ধরা যায়।
  • অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, এ তো বলাই বাহুল্য । আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে লিভারের অসুখ থেকে মুক্ত থাকা।

কী করবেন

১. বিশুদ্ধ পানি বেশি বেশি পান করবেন। ২. সহজপাচ্য খাবার খাবেন।

৩. রান্না না করা খাবার যেমন ফলমূল, টমেটোজাতীয় সবজি খুব ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে খাবেন।

৪. আমিষ গ্রহণ করতে চাইলে মাছকে বেশি প্রাধান্য দেবেন।

৫. দক্ষিণ কোরিয়া, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার অনেক সমীক্ষায় দেখা গেছে,

প্রোবায়োটিক জাতীয় সাপ্লিমেন্টারি ওষুধ যেমন- প্রোটেকসিন লিভারকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। যদি সম্ভব হয় প্রতি বছর একবার একটানা দুই মাস এটি খেতে পারেন ।

৬. হেপাটাইটিসের টিকা নেবেন।

৭. কোনও কারণে শরীরে রক্ত নিতে হলে সব ধরনের স্ক্রিনিং টেস্ট করার পরে সেই রক্ত

গ্রহণ করবেন।

কী করবেন না

  • ১. পানি বা অন্য কোনও তরল খাদ্য যদি পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ নয় বলে আপনার মনে হয়, তাহলে কিছুতেই তা পান করবেন না।
  • ২. পুরনো ব্যবহৃত সিরিঞ্জ কখনই আপনার শরীরে পুশ করতে দেবেন না। ৩. বেশি চর্বিজাতীয় খাদ্য খাবেন না। ৪. অ্যালকোহল খেলে নিট পরিমাণ দিনে ৮০ মিলির বেশি কিছুতেই খাবেন না।
  • ৫. সেলুনে দাড়ি-গোঁফ কাটতে যাবেন না।  
  • ৬. পেশাদার যৌনকর্মীর সঙ্গে মিলিত হবেন না । কনডম ছাড়া তো একেবারেই না।
  • ৭. অনেক ওষুধ লিভারের ক্ষতি করে তাই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া পারতপক্ষে কোনও ওষুধ খাবেন না।

Leave a Comment